রত্না
ধুলো ঝেড়ে চ্যাটবক্স থেকে উদ্ধার করলাম তিন বছর আগের মেসেজ। ডেস্কটপে নাসরিন সোতুদের নামটা ভেসে উঠেছে।
“এখন খুব ব্যস্ত আর চাপে আছি। প্লিজ, কথা বলা যাবে না এখন।” নাসরিনের সঙ্গে এই কথোপকথন হয় ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে।
এরপরে গ্রেফতার হয়ে যান নাসরিন। এখন জেলের ভিতর, টানা ৪০ দিন অনশনে। ঝাপসা হয়ে এসেছে দৃষ্টি, ওঠার ক্ষমতা নেই। লিকলিকে শরীরে অবশিষ্ট শুধু অদম্য জেদ, বড় বড় চোখে লড়াই কাজল পরিয়ে দিয়েছে।
লড়াই – নাসরিনের খুব প্রিয় শব্দ।
নাসরিন সোতুদে ইরান এবং গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেওয়া একটি নাম।
সাতান্ন বছর বয়সী নাসরিন সোতুদে ইরানের রাঙা পলাশ। মুক্ত কণ্ঠ, মুক্ত লেখনীর হয়ে বার বার প্রতিবাদের স্বর হয়ে ওঠা মানুষদের হয়ে কোর্টে দাঁড়িয়ে লড়েছেন, নাসরিন তেমনই একজন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী। এমন একজনকে ইরানের খামেইনি সরকার জেলের বাইরে রাখবে তা কেমন করে হয়! তাই নাসরিন সোতুদে এখন জেলে।
ইরানের রাজধানী তেহরানের ইভিন জেল রাজনৈতিক বন্দিদের রাখার জন্যই বিখ্যাত। এই ইভিন জেলেই আছেন নাসরিন। উত্তর ইরানের আলবোর্জ পর্বতমালার কোলে ইভিন জেল। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রেভোল্যুশন-এর পর ইরানে রাজনৈতিক পালা বদল হয়। খামেইনিরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ইভিন জেলেই রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হয়। বলা ভালো, ইভিন জেল তৈরিই হয়েছিল প্রতিবাদী, সরকারের সমালোচক, গণতন্ত্র, নারী অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার মানুষদের আওয়াজকে রুদ্ধ করতে।
আরো পড়ুন: তন্ত্র, মন্ত্র, গণতন্ত্র – পর্ব ১, হাতির মৃত্যু এবং কুমিরের কান্না
২০১৮ সাল থেকে জেলের ভিতর নাসরিন। ছাড়ার পাত্র নন। জেলের ভিতরে থেকেই রাজনৈতিক বন্দিদের অকারণ জেল বন্দি করার বিরুদ্ধে তিনি অনশন করে চলেছেন। এর আগে একবার টানা ৪৯ দিনের অনশন করেছিলেন নাসরিন। ২০১০ সালে, প্রথমবার যখন গ্রেফতার হন। পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া এমনকি ফোনেও কথা বলতে না দেওয়ার প্রতিবাদে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল লম্বা। সেখানে এমনকি, বেশ্যাগিরিও আছে।
এছাড়া মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে যে যে অভিযোগ সাধারণত দেওয়া হয়ে থাকে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এসব তো আছেই । ২০১১-য় নাসরিনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড সহ তাঁর প্র্যাক্টিস বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ আসে আদালত থেকে। সঙ্গে ২০ বছর দেশের বাইরে না যাওয়ার হুকুমনামা। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে নাসরিনের জেলে যাওয়ার খবর। পরে অবশ্য ৬ বছর কারাদণ্ডের পরেই ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
ইরানে কিছু ঘটলে বিশেষত মানবাধিকার কর্মী বা সামাজিক কর্মী গ্রেফতার হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ইন ইরান, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এবং আমেরিকার কিছু বিশেষ রাইটস গ্রুপ। এতে রাজনীতি অবশ্যই আছে, ইরানকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় বেশ অপদস্থ করা যায়, এর জন্যই ওঁৎ পেতে থাকে ওরা। সফলও হয়। ইরানকে অপদস্ত করার জন্য ইউরোপ এবং আমেরিকার এই সুযোগের সদ্ব্যবহার পাল্টা কাজে লাগান কট্টর ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মীরাও।
আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকে মহিলা এবং শিশুদের আইনি অধিকার রক্ষার কাজ করতেন নাসরিন। তারপর মানবাধিকার কর্মী, কট্টর ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সাংবাদিক, এবং রাজনৈতিক বন্দিদের হয়ে কেস লড়তে শুরু করেন। ইরানকে ধর্ম-নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন যাঁরা দেখেছিলেন তাঁদের যখন রাষ্ট্রশক্তি অপদস্ত করত, জেলবন্দি করত তাঁদেরই কণ্ঠ হয়ে উঠতেন নাসরিন। নির্ভীক, সাহসী, আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো নাসরিন সোতুদে।
আরো পড়ুন – তন্ত্র, মন্ত্র, গণতন্ত্র, পর্ব ২: বাকি কাহিনী পড়ে থাকবে কাশ্মীরের অসংখ্য গিরিখাতের ভিতরে খামবন্ধ হয়ে।
নোবেল পিস প্রাইজ জয়ী শিরিন ইবাদি, সাংবাদিক এবং এক্টিভিস্ট কুরোস জাইম, ওমিদ মেমারিয়াম, ইরানের বিখ্যাত এক্টিভিস্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লড়াইয়ে সামিল হেশামত তাবারজাদি, নারীর সমানাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিনের কণ্ঠস্বর পারভিন আরদালান, কার হয়ে লড়েননি নাসরিন।
সরকারের কণ্ঠরোধী নীতি চ্যালেঞ্জ করে বিপাকে, কট্টর পন্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বেকায়দায়, কোনো আইনজীবীকে পাচ্ছেন না? হাজির নাসরিন সোতুদে। কোর্টরুমে বিচারকদের চোখে চোখ রেখে সওয়াল জবাব আর বেতের মত প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া নাসরিন এখন ইভান জেলে, একাকী। সময় যত গড়িয়েছে নাসরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। হার মানেননি নাসরিন। রাতের পর রাত বাড়িতে বসে সওয়াল জবাব তৈরি করেছেন আর দিনের বেলা বিচারকের সামনে গিয়ে প্রশ্নের পর ছুড়েছেন, প্রশ্ন করেছেন, জবাব না পেয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছ্নে। বছরের পর বছর।
নিজে মাথা ঢাকা পছন্দ করতেন না। তাই বাধ্যতামূলক রোসারির (ইরানে হিজাবকে রোসারি বলা হয়) বিরুদ্ধে যে মেয়েরা প্রতিবাদ জানাতো তাদের পাশে দাঁড়াতেন নাসরিন। কোর্টে রুমেও চলে যেতেন মাথায় কাপড় না দিয়ে। বিচারকদের বিরক্তি আর তিরস্কারে আবার মাথায় কাপড় দিয়ে নিতেন। সওয়াল জবাব শুরুর আগে এমনই চাল চালতেন। বিচারকরা জানতেন একগুঁয়ে নাসরিন মানসিক খেলা খেলছেন।
মাথার স্কার্ফ খুলে জনসমক্ষে আসা ইরানে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, আর এরই বিরুদ্ধে বেশ অনেক বছর ধরেই আন্দোলন করছেন ইরানের মেয়েরা। ২০১৭-র ডিসেম্বর মাসে এক তরুণী তেহরানের ইনকিলাব স্ট্রিট-এ একটি উঁচু জায়গায় উঠে মাথার স্কার্ফ খুলে লাঠি দিয়ে ওড়াতে থাকে। সঙ্গে তাঁর ১৯ মাসের সন্তান। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিও। কোটি কোটি মানুষ দেখেন ভিদার খোলা মাথা, হাওয়ায় উড়তে থাকা লম্বা খোলা চুল আর ফিনফিনে সাদা স্কার্ফ। প্রতীকী, কিন্তু উচ্চকিত। কিছু মুহূর্ত পরেই ভ্যানিশ হয়ে যান তরুণীটি। তোলপাড় তেহরান, সিরাজ, ইস্ফাহান। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়। পার্সিয়ান ভাষায় হ্যাশট্যাগ শুরু হয়ে যায় “Where is the girl of Enghelab Street”. ইনকিলাব স্ট্রিটকে তেহরানে রেভোল্যুশন স্ট্রিটও বলা হয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও সেই খবর শিরোনামে জায়গা করে নেয়। “কোথায় ভিদা?”
খামেইনিদের বিরুদ্ধে আরো সংগঠিত হতে শুরু করেন মেয়েরা। রাস্তায় ঘাটে মাথার কাপড় খুলে প্রদর্শন করতে থাকেন। কিছুটা বেসামাল খামেইনি সরকার।
আরো পড়ুন – তন্ত্র, মন্ত্র, গণতন্ত্র, পর্ব ৩: রাষ্ট্রশক্তির কাছে ড: কাফিল খানের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত
চুপচাপ কাজ শুরু করে দেন নাসরিন সোতুদে। মেয়েটির সমস্ত তথ্য বার করে ফেলেন। জানা যায়, মেয়েটির নাম ভিদা মহাভেদ। বয়স ৩১। প্রতিবাদের পর পরই ভিদাকে তুলে নিয়েছে খামেইনি সরকার। তারপর অনন্ত প্রহর কেটেছে নাসরিনের। দুচোখের পাতা এক করেননি যতদিন না ভিদাকে জেল থেকে বার করে এনেছেন। কেটে গেছে এক মাস।
এই ঘটনার পর থেকে আরো বেশি করে চাপে ছিলেন নাসরিন। আবার যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করা হবে বুঝতে পারছিলেন।
এই সময়ই আমার সঙ্গে নাসরিনের ছোট্ট কথোপকথন। চ্যাট বক্সে ভেসে উঠে সেই কথোপকথন। ইরানের সবথেকে জনপ্রিয় এবং সরকারের কাছে কুখ্যাত মানবাধিকার কর্মীকে মোক্ষম সময়টিতে ধরা, কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে। প্রস্তাব রাখতে কয়েক মিনিট বাদেই, ভেসে উঠলো উত্তর। সেই সময় ইরানের সবথেকে নেক নজরে থাকা মানুষটি বললেন, ‘খুব ব্যস্ত আর চাপ। বোঝার চেষ্টা করুন, কথা বলতে পারবো না।”
বুঝতে তো পারছিই। তবু লেগে রইলাম। বললেন, “প্লিজ, এখন নয়, কথা বলবো কোনো এক সময় বুঝে।”
বিবিসি থেকে শুরু করে সিএনএন, ফক্স, আলজাজিরা, ফ্রান্স-২৪, ডি-ডব্লু, সান, ডেইলি মিরর, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, টাইম, সবাই লাইন দিয়ে, নাসরিনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না। সবাই টুইটার আর ফেসবুকে তাঁর পেজ থেকে করা পোস্ট নিয়ে খবর করছে। নাসরিন চুপ..
বোঝাই যায় অসম্ভব চাপে আছেন। মর্টার পড়ছে তাঁর বেডরুমে।এর ঠিক এক বছর পর আবারো গ্রেফতার হন নাসরিন। ৩৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে তাঁকে ইরান সরকার! সঙ্গে ১৪৮ টি বেত্রাঘাত। অনশনের ৪০ দিন পার করেছেন। শরীর ভেঙে পড়ছে, দুর্বলতা নড়াচড়া করতে দিচ্ছে না। স্বামীকে দেখা করতেও দেওয়া হচ্ছে না !
ওঁর স্বামী গত ১৪ সেপ্টেম্বর পোস্ট করেছেন, ‘৩৫ দিন হয়ে গেলো নাসরিন অনশনে। আমাকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফোনে কয়েকদিন আগে কথা হলো। খবর পেলাম ওর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ছিছিক্কার, নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি চিঠির গোলাপ পাঠাচ্ছেন নাসরিনকে। ফেসবুকে পোস্ট হচ্ছে, “স্বাধীন কণ্ঠ রোধ করা যাবে না।” “নাসরিন কে বাঁচাতে হবে।”
কীভাবে, কেউ জানেন কি ?
নাসরিনের স্বামী আরো একদিন লিখেছেন, “রাজনৈতিক কার্যকারিতার মাধ্যমে সরকারের মূল লক্ষ্য জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।”
এতটা পড়ে ভাবছেন ঘোর অন্যায় হচ্ছে, গুরুতর অবিচার হচ্ছে নাসরিনের সঙ্গে!
তাহলে নিজেদের দিকেও যে একটু তাকাতে হয়!
নাসরিন সোতুদেতে উপছে পড়ছে আমার দেশের কারাগার। ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠা আমার ভারত, চারপাশে অচেনা হয়ে যাওয়া মানুষের ভারত। হাজার হাজার নাসরিন সোতুদের ভারে জেল উজাড় হয়ে যাছে আমার দেশের! হ্যাঁ, ইরান নয়, আমাদের, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে!
আসলে স্বৈরাচারের কোনও ভৌগোলিক সীমানা হয় না! অতিমারি ধর্মের পিঠেই জড়িয়ে থাকে স্বৈরাচারের নামাবলী!
At least india and the palefaces should not have anything to do with nasreen as they are the principal culprits in their own countries
Good exposure