তন্ত্র, মন্ত্র, গণতন্ত্র – পর্ব ২

ayyad-crpf
যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রেম! ছবি সৌজন্য: জম্মু কাশ্মীর পুলিশ টুইটার

রত্না 

৫ জুলাই, নয়াদিল্লি: টুইটারে এখন সুনামি। মুম্বইয়ের সাংবাদিক রানা আয়ুবকে ধর্ষণ এবং খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত ইনবক্স-এ ঢুকে তাঁকে বাছাই করে অশ্রাব্য এবং অকথ্য গালিগালাজ দিয়ে তাঁর সাহসের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কেন? রানার একটি পোস্ট। কাশ্মীর নিয়ে।

টাইমলাইনটাকে একটু রিওয়াইন্ড-এ নিয়ে যেতে হবে।

ছবিটা ভোলার কথা নয়। একটি মানুষ রক্তাক্ত, সাদা ধবধবে সুটের উপরে চাপ চাপ লাল রঙ, নিঃসাড় মানুষটি পড়ে আছেন রাস্তার উপর, আর তার বুকের উপরে একটি শিশু বসে অঝোরে কাদঁছে, ঘটনার ভয়াবহতায় থরথরে শরীর, আর তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন একটি সিআরপিএফ জওয়ান। ছবিটি মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তারপরেই আরও একটি ছবি, শিশুটি মায়ের কোলে। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে? কী আছে ওই চোখে? ভয় নেই। সন্দেহ আছে, অবিশ্বাস আছে। একটি শিশু চোখে আর কী চাই? ওই শিশু সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে, আমরা কেউ দেখতে পাবো না, আমরা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার নিয়ে তর্কের বিনুনি বাঁধবো। লকডাউনের বারান্দায় বসে উপভোগ করবো সুইমিং পুল ভিউ, আমরা গণতন্ত্রের ওয়াইন-এ বিভোর।

একটা ছবি কত শব্দ, কত জীবন, কত মৃত্যু, কত রঙ, কত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, কত শূন্যতা, কত না জানা .. আরও কত কিছুকে মনে পড়িয়ে দেয়। সেও একটা ছবি ছিল।একটি শিশু শূন্য সমুদ্র তটে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। 

আমাদের অবচেতন থেকে যায়নি ওই ছবি, আয়লান কুর্দি! লাল জামা, নীল প্যান্ট। মায়ের অতি যত্নে পরিয়ে দেওয়া ওই জামা কাপড়। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইউরোপ নামক স্বপ্নে পাড়ি দিতে জলপথে যাত্রা শুরু করেছিল পরিবারটি। একটা ছবি.. একটা অভিঘাত আসলে। কিন্তু কেন এই ছবি অমর হয়ে গেলো? আয়লান তো একা সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য বোটে চড়ে জলে ভেসে পড়েনি! আসলে সব আয়লানের ছবি ভাইরাল হয়না। ওই একটা ছবির পিছনে অনেক, ছবি থাকে, অনেক কাহিনী থাকে, কার্য-কারণ থাকে।

Alan_Kurdi_frankfurt
আয়লান কুর্দির ছবির গ্রাফিতি আর্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ মাইন্ নদীর ধারে। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

২০১১ সাল থেকে সিরিয়াতে অশান্তি, স্পষ্ট হয়ে গেছে সিরিয়ার তেলের জন্য আমেরিকার লোভ। তেল সমৃদ্ধ সব  দেশগুলোকেই মোটামুটি কব্জা করা গেছে, কিন্তু সিরিয়াকে কিছুতেই তালুবন্দি করা যাচ্ছে না। হার মানানো যাচ্ছে না।

তাই যুদ্ধ লাগাও। আর রাজায়-রাজায় এই যুদ্ধের অসহায় শিকার হন সাধারণ মানুষ। মানুষ দেশ ছেড়ে, ভিটে-জমি  ছেড়ে পালিয়েছিলেন, পালিয়েছেন, এখনো পালাচ্ছেন। এখনো পর্যন্ত ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ দেশছাড়া। দেশের মধ্যেই নিজ ঘর ছাড়া আরো ৬০ লক্ষ-র উপর, তাই একটি আয়লান তো হয়নি! আয়লানরা আছে, হাজার হাজার আছে, ছিলও। তাই একটি আয়লান এভাবে মরেনি, হাজার হাজার আয়লান উপুড় হয়ে পড়েছে রাজাদের পায়ের তলায়। তবু একটি আয়লান ছবি হয়।

এবার আসি কাশ্মীরের আয়াদের কথায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, কে তুলেছে এই ছবি? অমন যুদ্ধক্ষেত্রে! পুলিশ বয়ান অনুযায়ী ওখানে নাকি সেই মুহূর্তে চরম গুলি বর্ষণ চলছিল। সিআরপিএফ এটাও দাবি করেছে যে জঙ্গিদের গুলিতে আয়াদের ঠাকুরদা মারা গেছেন, সিআরপিএফ-র গুলিতে নয়। তবু আশ্চর্য হলো, সুন্দর ভাবে ছবি তোলার বেশ সময় পাওয়া গেলো । গুলি বর্ষণের মাঝে কারও হাত কাঁপলো না, ছবি সামান্য ঝাপসা হলোনা। আমরা গুলি বর্ষণের মাঝে একটি ঝকঝকে ছবি পেয়ে গেলাম। আর তা ভাইরাল হয়ে গেলো। গুলি যুদ্ধের সময়ও পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়া টিম থাকে! কাউকে ছবি তোলার দায়িত্ব দেওয়া থাকে! যদি ওই ছবি কোনো ফটোগ্রাফার তুলে থাকেন তাহলে কে তিনি? পুলিৎজার তো পাবেন, কিন্তু কাকে দেওয়া হবে জানা দরকার যে!

‘এম্বেডেড জার্নালিজম’ বলে একটা শব্দ আন্তর্জাতিক মিডিয়া কমিউনিটিতে খুবই প্রচলিত। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্র বা মিলিটারি অপারেশনে নিজেদের সঙ্গে সাংবাদিক রেখে দেওয়া, যাতে মিলিটারি বা শাসক দল যা করবে তার পক্ষে লেখা বা ছবি হয়, কারণ যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের যাওয়া সম্ভব নয় যদি না মিলিটারি নিয়ে যায় বা তাদের অনুমতি না থাকে। তাই স্বাভিকভাবেই কভারেজ যা হয় সেটা মিলিটারির পক্ষেই হয়, কারণ তারাই সাংবাদিকদের নিয়ে যাচ্ছে।

ভারতে এই শব্দের ব্যবহার নেই। কারণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতে এখন পুরোটাই ‘এম্বেডেড জার্নালিজম’, আলাদা করে বলতে হয়না। এটা কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে তন্ত্র, মন্ত্র, গণতন্ত্রের অন্য কোনও পর্বে।

rana-ayyub
রানা আইয়ুব ক্রমাগত ধর্ষণ এবং খুনের হুমকি পাচ্ছেন

রানা আয়ুব, অর্থাৎ যে সাংবাদিকের টুইটার পোস্ট নিয়ে এই লেখা শুরু করেছি, তিনি এই এম্বেডেড জার্নালিজম করেননি। শিল্পী মীর সোহেলের আঁকা একটি রাজনৈতিক কার্টুন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। সেই জন্যই সোশ্যাল মিডিয়ার গুন্ডারা হুমকি দিতে শুরু করেছে। রানা কাশ্মীর নিয়ে এবং ইস্যু ভিত্তিক কথা বলে অনেকদিন ধরেই আক্রমনের লক্ষ্য। এবার আরও একবার।

rana ayyb post
শিল্পী মীর সোহেলের আঁকা এই ছবি রানা আইয়ুব সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন

এবার যা বলছিলাম, শিশুটি অর্থাৎ আয়াদ বাড়ি ফিরে বলেছে পুলিশ মেরেছে তার পিতামহ বশির আহমেদ-কে! তা শুনে পুলিশ বলেছে পরিবারকে নাকি জঙ্গিরা চাপ দিচ্ছে একথা বলার জন্য! জঙ্গিরা তাহলে তিন বছরের শিশুকেও বাধ্য করছে মিথ্যা বলতে! কাকে বোঝাচ্ছ রাষ্ট্র? আমরা তো মুক বধির হয়েই গেছি। আমরা নয় ভক্ত হনুমানের মত গন্ধমাদন কাঁধে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যাই, তাবলে একটা তিন বছরের শিশু! যে নাকি সেই মুহূর্তের একমাত্র সাক্ষ্য! তাকেও ছাড়ছ না! তার দুটো অবিশ্বাসী চোখ তোমাদের কাউকে কোনোদিন ক্ষমা করবে? এই শিশু ভবিষ্যতে ‘জঙ্গি’ হয়ে উঠলে তার দায়িত্ব কার?

কিন্তু জনগণ, এতো পরবর্তী কাহিনী। ছবি পরবর্তী কাহিনী যা আপনার আমার কারোর মনে থাকবে না, তার আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। শাসক দলের মিডিয়া ম্যানেজার থেকে সোশ্যাল মিডিয়া মেশিনারি যা করার করে দিয়েছে। রাজনীতি আর প্রোপাগান্ডার মিশেলে অমর করে দেওয়া হলো একটি ছবি, একটি শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে একটি জওয়ান। বাকি কাহিনী পড়ে থাকবে  কাশ্মীরের অসংখ্য গিরিখাতের ভিতরে খামবন্ধ হয়ে।

dal-lake
                               ডাললেক, কাশ্মীরের উপর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার ঠিক এক মাস পর, ছবি: রত্না

কাশ্মীর জ্বলছে, অনেকদিন ধরে, কাশ্মীরের কবিতা তাই প্রতিবাদের, ঝিলামের জলের রং যদি লাল হতে থাকে, তাহলে চিনার নিয়ে কোনো রোম্যান্টিক কবিতা লেখা যায় না,  হাহাকারের পাঁচালি কাঁপন ধরায় চিনার পাতায়। যারা বাইরে থেকে কাশ্মীরে গিয়ে চিনার নিয়ে কবিতা ভাবি আর শিকারায় পর্যটক না থকা নিয়ে দুঃখ আওড়াই, তাদের কাশ্মীর আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম মার্ খেয়ে, গুলি খেয়ে, প্যালেট খেয়ে, উর্দিধারীদের থেকে বিনা কারণে গালি খেয়ে, লাঠি খেয়ে, নিজের বাড়ির বাইরে ভারী বুটের শব্দ শুনে প্রতি রাত্রে ঘুম ভাঙা, হঠাৎ মাঝ রাতে কাঁপতে কাঁপতে নিজের মেয়েকে বিসর্জন দেওয়ার কাশ্মীর, অন্য কাশ্মীর।

আর অন্য কাশ্মীর নিয়ে বিভোর আমাদের চোখের সামনে পরে থাকা অসংখ্য ছবি গুলিয়ে দিতে আয়াদের ছবি খুব দরকার। আমরা ‘হিউম্যান স্টোরি’ দেখবো। একটা ছবি নিয়ে তওবা তওবা করবো…টিভি চ্যানেলে সারাদিন শিরোনাম চলবে।

আয়লান, আয়াদ – কেউ মরে গিয়ে, কেউ বেঁচে থেকে ঘুঁটি হয়ে যাবে।

আয়লান কুর্দি আসলে ডোবেনি, আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে গেছে।

6 Comments

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s