ভাষা নিয়ন্ত্রণেই ভাবনা নিয়ন্ত্রণ — কীভাবে?
জুন ২, ২০২৩, ভাবনা পক্ষ – ১:
“ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
‘ইংলিশ’ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানে দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।”
১৯৫৩ সালে যে কবি জন্ম নিয়েছিলেন সেই ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখেছেন এই কবিতা। ১৯৯৮ সালে কবি মারা গেছেন।
বাংলা ভাষাকে বাঙালির এই অবমাননা, অশ্রদ্ধার ছবি কবি এঁকে গিয়েছিলেন বেশ কয়েক দশক আগেই। কিন্তু এটার পিছনে কারণ কী? আপনি বলবেন বাহ্, ইংরেজি না শিখলে আমার সন্তান সামাজিক সিঁড়িতে উপরে উঠবে কীভাবে ? আমরা ইংরেজি না শেখার কিন্তু কথা বলছি না। আমরা আজকে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো সেটা হচ্ছে মাতৃভাষা সে ভারতের যে ভাষাই হোক না কেন, ওড়িয়া, মারাঠি, মালায়ালী, তামিল, পাঞ্জাবি, যেকোনও ভারতীয় ভাষা হতে পারে, সেই মাতৃভাষাকে কেন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাখা হবে না? এবং মাতৃভাষা কেন কাজের ভাষা হবে না। কারণ আজ একটা পশ্চিমি ভাষা, একটা বিদেশী ভাষাকে আমরা নিজেদের ভাষা বলে পরিচয় দিয়ে ফেলছি প্রায়, সেই ভাষা আমাদের ঔপনিবেশিকদের ভাষা (English language imperialism)।
এটা কি আমাদের লজ্জা নয়? এই ভাষা সাম্রাজ্যবাদ (linguistic imperialism) থেকে কেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারবোনা? কেন বেরিয়ে আসার চেষ্টা থাকবে না ?
তার কারণ আপনি যদি ভাষা নিয়ন্ত্রণ করেন, আপনি ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করবেন। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। ঠিক এটাই ঘটছে। ভাষার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বোধহয় আজকের পৃথিবীর বহু সমস্যার মূলে।
অসাম্যের বীজ রোপন করা হয়েছে এই ইংরেজি ভাষার কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। আজ আমরা হিন্দির আগ্রাসন নিয়ে বিদ্রোহ করি, যা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত, কিন্তু ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন নিয়ে আমরা কথাই বলিনা। হিন্দির মতো ইংরেজি ভাষাও তো একদিন আরোপ করা হয়েছিল। ওই যে বললাম ভাষার মাধ্যমে ভাবনা নিয়ন্ত্রণ।
আপনাদের এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি পৃথিবীর বহু দেশ তাদের মাতৃভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ইউরোপের বহু দেশ, তাছাড়াও চীন, রাশিয়া, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া, জাপান, কোরিয়া। ইতালি তো অতি সম্প্রতি নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সরকারি কাজকর্মে ইংরেজি নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে (Italy bans English)। এবং এই ঘটনা ইংরেজি প্রেস অর্থাৎ তথাকথিত ‘ফ্রি-প্রেস’ খুব নেতিবাচকভাবে দেখিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে, যে চাইলে করা যায়। কিন্তু চাইবে কে, কারা? মেধাযুক্ত ভারতীয়দের, কর্পোরেট চাকরিতে দরকার, তাই ব্যবস্থা এমন রাখতে হবে যাতে ইংরেজিই তারা মূল ভাষা হিসেবে শেখে। কারণ পশ্চিমি দেশ চোস্ত ইংরেজি জানা কমদামি ভারতীয় কর্মী ছাড়া চলবে না।
আজ সিলিকন ভ্যালি আর জেনেভায় বসে যারা গোটা বিশ্ব চালাচ্ছে তারা কেন ভাষার বিকেন্দ্রীকরণ চাইবে? বরং উল্টোটা ঘটে। যেরকম রিসোর্সেস কব্জা (Resources loot) করার জন্য ইউরোপ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড নানা দেশে গিয়ে ঢুকে পড়ে ঠিক সেরকমই তারা নানা দেশে গিয়ে শিক্ষা পলিসি নির্ধারণে প্রভাব খাটায়।
এ বিষয়ে আমাদের আমরা রিসার্চ করেছি। বেশকিছু বই এবং পেপার্স-এ এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা আছে।
আর ভারতীয়রাও এখনো ঔপনিবেশিকতার রেশ (Colonial hangover) কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই যা কিছু পশ্চিমি তাই ভালো এরকম একটা মানসিকতা আছেই আর তাই দারুন সুবিধে হয়েছে পশ্চিমি দুনিয়ার। ওই যে বললাম ভাষার মাধ্যমে ভাবনা নিয়ন্ত্রণ। তাই সেই একই দাসত্ব চলছে অন্য আঙ্গিকে অন্য রূপে। নিজেদের ভাষাকে কাজের ভাষা, শিক্ষার ভাষা না করলে এই দাসত্ব থেকে কি বেরিয়ে আসা সম্ভব?
Empire Diaries-র ভাবনা পক্ষের প্রথম এপিসোডে আলোচনার বিষয় এটাই।
ভাবনা পক্ষ – হোম পেজ
REPUBLISHING TERMS:
All rights to this content are reserved. If you want to republish this content in any form, in part or in full, please contact us at writetoempirediaries@gmail.com.