রত্না
কৃষক আত্মহত্যা সংগঠিত এবং পরিকল্পনামাফিক হিংসার ফল নয়?
গাজিয়াবাদে সকাল ১০-১৫ নাগাদ, একটা ট্র্যাক্টর বোল্ডার ফেলে দিয়েছে। বোল্ডার মাটিতে পড়ে আছে, বিপ্লবী ট্র্যাক্টর তার সামনে। ছবিটা তুলতে তুলতে মনে হচ্ছিলো এটা কি প্রতীকী?
তার কিছু পরেই লালকেল্লা ‘দখল’।
লালকেল্লা ‘দখল’এর পর ছিছিক্কার পড়ছে।
অন্নদাতারা কেন ‘হিংসা’র আশ্রয় নেবে?
রাজধানীর সংসদে তাদেরই ভোটে নির্বাচিতরা দুর্যোধন হয়ে উঠলে আর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এলে তাদের আটকে দেওয়া হবে, তারপর তারা ১ ডিগ্রী ২ ডিগ্রীতে তাঁবুতে শুয়ে শীতের আঁচড়ানি-কামড়ানি খাবে, মাসের পর মাস পাবলিক ল্যাট্রিন ব্যবহার করবে, ট্রাক্টরে ১০ জন গুঁতোগুঁতি করে শোবে, ভোর ৫টায় উঠে বাদামের দুধ বানিয়ে, পাকোড়া, আখের রসের ক্ষীর বানিয়ে হাসি মুখে খাওয়াবে – কৃষক তো এমনই হবে!
তারা শুধু বর্ডার-এ রুটি, ডাল-মাখনি, সবজি-পাস্তা আর পায়েস ছড়াবে। মায় লাঠি খেদানো পুলিশ, নিরাপত্তারক্ষীরাও তাদের আদর পাবে। সহনশীল, শান্তিপূর্ণ, দয়া-মায়া ভরা মুখ, এক গালে থাপ্পড় দিলে আর এক গাল বাড়িয়ে দেবে। তারা তো মায়ের মত! এই না হলে কৃষক!
এই কৃষকদের অন্য রূপ কেন থাকবে?
এর বাইরে কিছু ঘটলেই তাই গেলো গেলো রব!
কোনটা হিংসা, কোনটা প্রতিবাদ?
হিংসা শব্দটা আসলে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের একটা চরম আশ্রয়। চমস্কি বলেছিলেন না, কোনটা আইনি আর কোনটা বেআইনি তা কে নির্ধারণ করে? রাষ্ট্র করে! সুবিধাবাদের জন্য হিংসা শব্দের কত ব্যাপক ব্যবহার।
জাতীয় অপরাধ রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৪২,৪৮০ জন কৃষক এবং শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রায় তিন লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তাঁরা হিংসার শিকার নন? এটা সংগঠিত হিংসা নয়? আন্দোলন বন্ধ করার জন্য ব্যারিকেড দিয়ে নিজের দেশের রাজধানীতিতে ঢুকতে না দেওয়া হিংসা নয়?
খালিস্তানি দাবির সমর্থক দীপ সিন্ধু-র অনুগামীরা লালকেল্লায় ঢুকে পড়েন বা সাধারণ কৃষকরা, বিশ্ব জুড়ে যতগুলো কৃষক আন্দোলন চলছে তাদের প্যাটার্ন অনেকটা এই রকমই। যেকোনো বৃহৎ আন্দোলন এভাবেই হয়, গোটা বিশ্বে। ইতিহাসও তাই বলে। কৃষক নেতা রাকেশ টিকাইত, জগজিৎ সিংহ দালিয়ালরা যাই বলুন না কেন। সম্প্রতি পেরু, নেদারল্যান্ডস-এ এই একইভাবে কৃষক আন্দোলন হয়েছে। মাসের পর মাস পেরুতে এরকমই কৃষক আন্দোলন চলার পর সরকার বাধ্য হয়েছে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। সেখানেও কৃষি এবং কৃষি পণ্যের বিপণন কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত। সেটা হিংসা নয়? এই হিংসা নিয়ে আমরা কবে কথা বলবো? যাঁরা শীতের কামড়ানিতে দিল্লির বর্ডার-এ শহীদ হলেন, হচ্ছেন তাঁরা হিংসার শিকার নন? হচ্ছেন না?
হিংসা কি কেবল যা চোখের সামনে দেখা যায় সেটাই?
হ্যাঁ, আইটিও-তে পুলিশকে তাড়া করে ট্র্যাক্টর নিয়ে পাকদন্ডি যারা দিচ্ছিলেন তা দেখে শিউরে উঠতে হয় । সেখানে বড় কিছু ঘটতে পারতো, ঘটেনি এটা স্বস্তির বিষয়। এটা হিংসা, হুলিগানিজম। এটা যারা করেছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি অবশ্যই দেওয়া উচিত।
প্রতিবাদ আন্দোলনে মারা গেছেন এক তরুণ, যিনি ট্র্যাক্টর নিয়ে ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকতে গিয়েছিলেন। পুলিশ তাকে গুলি করেছে বলেও অভিযোগ। সেটা তদন্তের বিষয়। তাহলে হিংসা কে করল? সোচ্চারে অধিকার চাইতে গেলেই আতঙ্কবাদী! এখানে শুনতে পারেন এক কৃষক এই নিয়ে কী বলেছেন।
ব্যারিকেড ভেঙে বেরোনো যদি চরম হিংসা হয় তাহলে বছরের পর বছর কৃষক আত্মহত্যা আসলে সংগঠিত এবং পরিকল্পনামাফিক হিংসারই ফল।
ভারতীয় কিষান উনিয়নের রাকেশ টিকাইত বললেন, পুলিশের সঙ্গে বসে তাঁরা যে রুট ফাইনাল করেছিলেন সেই রুটেই ট্র্যাক্টর বার করতে গিয়ে ব্যারিকেড পেয়েছেন তাঁরা। এটা গাজিয়াবাদের ঘটনা। আমি নিজে গাজিয়াবাদে থাকায় দেখেছি একটি রাস্তা ছাড়া বাকি সব জায়গায় ব্যারিকেড।’ হাজার হাজার ট্র্যাক্টর একটি মাত্র রাস্তা দিয়ে বেরোনোর ফলে চূড়ান্ত অরাজকতা তৈরী হয়। তার সঙ্গে বারো, পনেরো হাজার লোক। এসব ক্ষেত্রে আন্দোলনের রাশ পাবলিকের হাতে চলে যায়। নেতাদের হাতে থাকে না। আর এই কাজ ভলান্টিয়ারদের নয়। নেতাদের লাঠি, বন্দুক, নিরাপত্তাকর্মী থাকে না। রাষ্ট্রের থাকে, পুলিশের থাকে। তাও ব্যারিকেড ভাঙার সময় রাকেশ টিকাইত লাঠি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে নিজে মেরেছেন ব্যারিকেড লঙ্ঘনকারীদের, ধমকেছেন।
প্রজা প্রজা খেলা
গাজীপুর বর্ডারে প্রথম ব্যারিকেড ভাঙার জায়গায় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। দূরে দাঁড়িয়ে বেশ হাসাহাসিও চলছিল সেই সময়। ওখানে লাঠি হাতে নামা বিপজ্জনক বলেই তাঁরা নামেননি। ভালোই করেছেন।
পুলিশ এটাও বলছে ,’এরাই তো দিনের পর দিন খাওয়াচ্ছে ম্যাডাম। কী ব্যবস্থা! সবাইকে খাওয়ানোর দ্বায়িত্ব যেন এদের। এদের হাতের বাদাম দুধ রোজ খাচ্ছি। লোক এরা খুব ভালো।’ এই কথোপকথন প্রজাতন্ত্র দিবসের ভোরের।
বাকি জায়গায় পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকায় তারা সেগুলো ব্যবহার করেছে। টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে, লাঠিপেটা করেছে, বহু কৃষক আহত হয়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাহলে কে করলো হিংসা? ব্যারিকেড ভাঙার সময়-ও কোনো কৃষক পুলিশকে আক্রমণ করেনি। যারা আশেপাশে ছিল তাদের সরে যেতে বলেছে। আমি নিজে সাক্ষী!
ছিল্লা বর্ডার বা সিংহু বর্ডার বা টিকরি বর্ডারে ট্র্যাক্টর নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছে। গাজীপুরেও তাই। তার আগেই অবশ্য খালিস্তান, পাকিস্তান, চিনেস্তান, মাওবাদী সব তকমা লেগে গেছে। বাদাম দুধ, দেশি ঘিয়ের লাড্ডু, সার্সো-দা-সাগ খাইয়েও।
দুদিন আগেই একজন সন্দেহভাজনকে ধরার পর সিংহু বর্ডারের কৃষক নেতারা পুলিশের হাতে তুলেও দেন। মিডিয়ার সামনে সে জানায় প্রশাসনের আন্দোলন ভাঙানোর পরিকল্পনা। এই প্রজাতন্ত্র দিবসেই চার কৃষক নেতাদের মারার নির্দেশের কথা। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া কোথাও সে খবর বিশেষ ভাবে বেরোয়নি। পুলিশ-প্রশাসন তাকে পেয়েই পাল্টা ভিডিও করে মিডিয়ায় পৌঁছে দেয়। যেখানে সে বলে তাকে দিয়ে জোর করে কৃষক নেতারা সন্ত্রাসের পরিকল্পনার কথা বলিয়েছেন! সন্দেভাজনকে দিয়ে ভিডিও বয়ান জারি করিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া পুলিশের কাজ?
গুলিয়ে দেওয়ার কাজটি রাষ্ট্র এখানেও নিপুণভাবে করেছে। পাবলিকের মাথা গুলিয়ে দাও।
এতো বড় আন্দোলনে সরকারি ইন্টেলিজেন্স যেমন তাগড়া, কৃষকরাও কম যাননা। তার প্রমান হাতেনাতে।
প্রতীকী যদিও
লালকেল্লা বরাবর রাজা-মহারাজাদের দম্ভ আর প্রজাদের আনুগত্যের প্রতীক হয়ে থেকেছে। সেখানে আজ নিরানকারীদের তলোয়ার প্রদর্শনী, পায়ে পায়ে ভিড়ে মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধ, আর অহংকার পদপিষ্ট হওয়ার প্রদর্শনী। কিন্তু সেখানেও তেরঙ্গা ঝান্ডা কেউ উপড়ে নেয়নি। আইটি সেলের ফেক খবর নিয়ে যারা কোনও কিছু না ভেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও ছড়িয়েছেন তাদের কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে কোনোদিন টুঁ শব্দ করতে দেখিনি।
আমি যেকোনো ধর্মীয় নিশানের বিরুদ্ধে। ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন আসলে মানব ধর্ম সংকটের বহিঃপ্রকাশ। তাই কোনোভাবেই সর্থনযোগ্য নয়, বরং চূড়ান্ত নিন্দার।
২০২০ চোরা পথে নিয়ে নিয়েছে আমাদের অনেককিছু। দূরত্ব, বিষন্নতা, বিপন্নতা আমাদের কুঁকড়ে দিয়েছে, ঘরে বসে থাকার দিনলিপি লিখিয়েছে। ২০২১-এর প্রথম মাস গণ আন্দোলনের ইতিহাসে আমাদের শেষের শুরু! সেখানে নেতা হিসেবে থাকুক না পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।