রত্না @blowinindwind
লাল, নীল, হলদে, সবুজ রঙের বেলুনগুলো নিয়ে আকাশে ওড়াতে চায় অজয়। কিন্তু পারে না। ওই বেলুনগুলো বিক্রি করে পঁচিশ, পঞ্চাশ, ষাট, আশি যেদিন যেমন তোলা যায়। নয়ডার সেক্টর ৪৯ থেকে ৭৬, ৭৭ ,৭৮ সেক্টরে চলে আসে, কারণ এখানে হাউসিং সোসাইটি অনেক বেশি, তার লাগোয়া ছোট ছোট বাজার। ওই মার্কেটগুলোই টার্গেট করে অজয়। লকডাউন পরবর্তীতে কিছু মানুষ আবার মার্কেটগুলোতে আসছেন। কেউ মুদির দোকান সারতে, কেউ ফল-সব্জি কিনতে, কেউ আবার দীর্ঘদিনের ইটিং-আউট উপোস কাটাতে কাবাব, রোল, বার্গার, পেস্ট্রির নিয়মে ফিরতে, এরাই টার্গেট অজয়ের।
সেক্টর ৪৯-এ বারোলে গ্রাম থেকে দুপুরবেলা বেরিয়ে পরে অজয়। অজয় যাদব, বয়স দশ। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক তিনটেয় পৌঁছে যায় সেক্টর ৭৬-এ। হাতে বেলুন। চোখে কাজলের রেখা। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। ব্যাগের এক দিকে প্লাস্টিকের বোতলে জল। ৭৬ সেক্টরের এক সোসাইটির বাইরের কল থেকে জল ভরে নেয়। নিথর স্কুল ব্যাগটা এখন আর কাজে লাগে না। থুড়ি, লাগে বৈকি! বেলুন বিক্রি করতে বেরোলে কাজে লাগে। পড়তো সে ৪৯ সেক্টরের সরকারি স্কুলে। সেতো কবেই ঝাঁপ বন্ধ।
বেলুনগুলো উড়ছে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কাঁধে স্কুল ব্যাগ অজয়ের আকাশের দিকে তাকাবার জো নেই। কাস্টমার ফস্কানো চলবে না। শিশু সন্তানদের হাত ধরে বা কোলে নিয়ে যারা আসছেন তারাই টার্গেট অজয়ের।
দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে চাড্ডি ভাত পেটে পড়লেও বিকেলে খিদে পেয়ে যায়। কিন্তু প্রতি পাই পয়সা গুনে গুনে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। কোনোদিন কপাল ভালো থাকলে একটা আধটা রোল, বিস্কুটের প্যাকেট বা ডিম্ পাউরুটি জুটে যায় বাজার-মুখী বাবুদের দয়াতে।
হঠাৎ সৌম্যকান্তি এক ভদ্রোলোক সম্ভবত নাতিকে নিয়ে বাজারের দিকে আসছেন দেখেই দৌড় দেয় অজয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে নাতি, এসেই দাঁড় করানো নানারকম বাইকে উঠে খেলা দেখতে শুরু করে পাঁচেকের শিশু । বিরক্ত মানুষটির বেসামাল অবস্থা। পৌঁছে যায় অজয়। হাতে বেলুন নিয়ে। ভদ্রলোক হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। অজয়ের পকেটে দশ টাকা ঢোকে।
উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসির বান্দা গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছে অজয়রা। গ্রামে কিছু খেতি জমি আছে। অজয়ের পাঁচ ভাই এক বোন। বড় দাদা বিয়ে করে আলাদা থাকে। মা শহুরে পরিবারগুলোতে সহায়িকার কাজ করে, যারা অজয়দের মতোই ‘মাইগ্রান্ট’। লকডাউন-এ কাজ গেছে মায়ের। ‘বাবা সকালে ৪৯-এর লালাবাতিতে যায় তারপর সেখান থেকে কিছু পেলে কাজ, না পেলে এদিক ওদিক দেখে, তারপরও কিছু না পেলে বাড়ি চলে আসে।’ মাথা নিচু করে পায়ে পা ঘষে বছর দশের ছেলেটা।
বেলুন ফিরি করার থেকেও বড় কাজ চাল, ডাল, আটা, নুন, পাউরুটি চেয়ে-চিন্তে যতটা সম্ভব জোগাড় করা। স্কুল ব্যাগটা তখন খুব কাজে লাগে।
‘আমি যা টাকা নিয়ে যাই মা ব্যাঙ্কে জমা রাখে। বলেছে আমি বড় হলে কাজে লাগবে।’
নয়ডার সেক্টর ৪৯-র লালবাতি। সকাল ছ’টা থেকে ভিড় জমতে শুরু করে। মানুষে মানুষে ছয়লাপ হয়ে যায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে। শ্রম বিক্রির ফেরিওয়ালাদের একজন বাবুলাল যাদব। অজয়ের বাবা। প্রতিদিন সকালে এখানেই সে যুদ্ধে নেমে পড়ে। এখানে আসে কোম্পানির কন্ট্রাক্টররা। শেষ বেলায় দরাদরি করে শ্রমের মাপ-মজুরি হয় দাড়িপাল্লায়। বাবুলাল প্রতিদিন দাঁড়িপাল্লায় চড়ে। সোনাগাছির শরীরের পসরা নিয়ে দোর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের মতই। যেদিন কাস্টমার জুটলো ভালো, যেদিন না জুটলো সেদিন শরীর সাজিয়েও কোনো লাভ হয়না। কাজ জুটলে পিল পিল করে ট্রাক্টরে উঠে পড়ে ওরা। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বাবুলালদের কাঁধে চড়ে টগবগ দৌড়তে থাকে! পিছন দেখার সময় নেই অজয়ের বাবাদের।
গণতন্ত্র খিদে পেটে, ট্রাকে চেপে দৌড়োচ্ছে! গণতন্ত্র বেলুন হয়ে অজয়ের হাত থেকে অন্য হাতে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভরা তখন ডাইন খুঁজছে, বলিউডি ড্রাগে রাজনীতির ড্রাগ মিশিয়ে ককটেল সার্ভ করছে বোকাবাক্স আর গণতন্ত্রের ড্রাগ টেনে শীর্ণকায় ভারতবর্ষ তাকিয়ে আছে ওই বোকাবাক্সের দিকে।